রাজা/মহারাজারা আজ আর বেচে নেই, কিন্তু কালের স্বাক্ষী হয়ে আজও আপন মহীমায় দাড়িয়ে আছে তাদের গড়ে যাওয়া রাজপ্রাসাদ। এমনি এক রাজপ্রাসাদ মহারাজ সূর্যকান্তের রাজবাড়ি অথবা ময়মনসিংহ রাজবাড়ী । শহরের কেন্দ্রস্থলে এবং ব্রহ্মপুত্র নদ থেকে অতি নিকটে অবস্থিত এই ময়মনসিংহ রাজবাড়ী । ময়মনসিংহ জেলার মুক্তাগাছা থানা শহরে ছিল শিবরামের বাসস্থানের অংশ । যাহা বর্তমানে কলেজবাড়ি নামেও পরিচিত। এই শিবরামের পুত্র সন্তান হলো রঘুনন্দন আচার্য চৌধুরী। কিন্তু তিনি ছিলেন নিঃসন্তান অথচ আমাদের এই পিতৃতান্ত্রিক সমাজে মৃত্যু পরবর্তিতে নিজের অস্থিস্থ জানান দিতে একজন পুত্র সন্তান ভীষণ প্রয়োজন।

তাই গৌরিকান্ত আচার্য চৌধুরীকে পালক হিসেবে নিয়ে আসেন। কিন্তু ভাগ্যর নির্মম পরিহাস, গৌরিকান্ত সন্তানহীন অবস্থায় অকালে মারা যান এবং তার বিধবা স্ত্রী বিমলা দেবী পালক নিয়ে আসেন কাশীকান্তকে। কিন্তু কাশিকান্তও দীর্ঘদিন রোগযন্ত্রণায় ভুগে অবশেষে সন্তাহীন অবস্থায় মারা যান। তারপর তার স্ত্রী দত্তক নিলেন চন্দ্রকান্তকে এবং চন্দ্রকান্তও অতিদ্রুত পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে পরোলোক গমন করেন। কিন্তু হাল ছাড়েননি লক্ষী দেবী, ফরিদপুরের বাজিতপুর গ্রাম থেকে মহারাজ সূর্যকান্ত আচার্য চৌধুরীকে পোষ্য পুত্র হিসাবে আসেন এবং তার পূর্বনাম ছিল পূর্ণচন্দ্র মজুমদার। পরবর্তীতে এই সূর্যকান্তের নামেই বাড়িটি পরিচিতি লাভ করে।

সূযকান্ত আচার্য চৌধুরীর শাসনামলে তার জমিদারি অঞ্চলে যোগ হয় এক নতুন মাত্রা এবং প্রায় 41 বছর তিনি তার জমিদাড়ি সুনামের সাথে পরিচালনা করেন। তিনি বহু জনহিতকর কাজ ও ময়মনসিংহে একাধিক দৃষ্টিনন্দন স্থাপনা তৈরী করেন। মহারাজ সূযকান্ত আচার্য চৌধুরীও ছিলেন অপুত্রক, তাই তিনি রাজা জগৎকিশোরের পুত্র শশীকান্ত আচার্য চৌধুরীকে দত্তক হিসেবে গ্রহণ করেন।

উনবিংশ শতাব্দিতে ময়মনসিংহ শহরে নয় একর জায়গার উপরে একটি দ্বিতল ভবণ নির্মাণ করেন সূর্যকান্ত আচার্য চৌধুরী। যারা পরবর্তিতে ছেলে  শশীকান্তের নামে নাম রাখা হয় শশী লজ। বিখ্যাত এই ভনণটি 1897 সালে গ্রেট ইন্ডিয়ান ভুমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্থ হয় এবং 1905 সালে ঠিক একই স্থানে ভবণটি পুর্ননির্মান করেন জমিদার শশীকান্ত আচার্য চৌধুরী। প্রাসাদের মুল প্রবেশপথে রয়েছে 16 টি গম্বুজ এবং শোনাযায় প্রবেশ পথের দুই পাশে এক সময় জিবন্ত বাঘ রাখা হত।

শশীলজের মুল ভবনের সামনেই রয়েছে বাগান এবং সেই বাগানের ঠিক মাঝ খানে রয়েছে শ্বেত পাথরের ফোয়ারা, যার মাঝখানে দাড়িয়ে আছে গ্রিক দেবী ভেনাসের স্বল্পবসনার মর্মর মূর্তি ।শশীলজে 36 টি ঘর রয়েছে এবং প্রায় প্রতিটি ঘরেই রয়েছে ঝুলন্ত ঝাড়বাতি, এছাড়াও আছে নাচঘর, গোসলখানা। এই গোসলখানার ঘরে একটি সুড়ঙ্গ রয়েছে। ধারণা করা হয় এই সুড়ঙ্গদিয়ে মুক্তাগাছা যাওয়ার ব্যবস্থা ছিল। ভবনটির পিছন দিকেও রয়েছে দ্বিতল গোসলখানা। ধারণা করা হয় রানী এখানে বসেই পাশের পুকুরের হাসের সাতার কাটা দেখতেন। পুকুরটির ঘাট মার্বেল পাথর দিয়ে বাধানো।

1952 সাল থেকে শশীলজ ব্যবহৃত হচ্ছে মহিলা শিক্ষিকা প্রশিক্ষণ কেন্দ্র হিসেবে এবং বাংলাদেশ প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর জাদুঘর স্থাপনের লক্ষ্যে 2015 সালে বাড়িটি অধিগ্রহণ করে।

বাড়িটির আশেপাশে রয়েছে বেশকিছু দুষ্প্রাপ্য ও পাচীন গাছপালা। আছে দুষ্প্রাপ্য নাগলিঙ্গম গাছ। যা একসময় হাতির খাবার হিসেবে দেয়া হত।

প্রতিদিন অসংখ্য ভ্রমণ পিপাসু মানুষ এই বাড়িটির ইতিহাস ও সৌন্দর্য দেখার ও জানার জন্য আগমন করে। শশীলজ ময়মনসিংহে অবস্থিত । ঢাকা থেকে সড়ক ও রেলপথ দুই ভাবেই যাওয়া যায় ময়মনসিংহে। প্রতিদিন মহাখালী বাসষ্ট্যান্ড / আব্দুল্লাপুর থেকে লোকাল এবং গেটলক দুই ধরনের বাস ছেড়ে যায় মযমনসিংহের উদ্দেশ্যে এবং নামবেন মাসাকান্দা বাসস্ট্যান্ডে। এরপর অটো রিকশা অথবা রিকশায় করে চলে যান শশীলজ। এছাড়াও কমলাপুর রেলষ্টেশন থেকে ছেড়ে যায় তিস্তা এক্সপ্রেস, মোহনগঞ্জ এক্সপ্রেস, যমুনা এক্সপ্রেস, হাওর এক্সপ্রেস। রেলস্টেশন থেকেই অটো রিকশা অথবা রিকশায় করে চলে যান শশীলজ।

ঢাকা থেকে ময়মনসিংহ দিনে গিয়ে ফিরে আসা যায়। এছাড়াও থাকার জন্য ভালো, মাঝারি, সস্তা মানের হোটেল রয়েছে।

শুভ ও নিরাপদ হোক আপনার যাত্রা।

আরও পড়ুন আলেকজান্ডার ক্যাসেল